বরগুনা: যে হাতে থাকার কথা ছিল বই-খাতা, সে হাতে মাছ ধরার জাল। যে হাতে ছবি আঁকার কথা ছিল, সে হাতে বইতে হচ্ছে নৌকার বৈঠা।
এমন এক শিশু সাব্বির। বয়স মাত্র ১০ বছর। বাবার নাম আর্শ্বেদ আলী। উপকূলীয় উপজেলা পাথরঘাটার বলেশ্বর নদ পাড়ের রুহিতা গ্রামে বসবাস তার। সাত বছর বয়স থেকেই অভাবের টানে মাছ ধরছে বলেশ্বর নদে। চোখে মুখে বিষণ্নতার ছাপ। শরীরের অবস্থা দেখে বোঝা যায় জীবিকার তাগিদে এ বয়সে মাছ ধরার কাজ করতে হচ্ছে তার। তবে এসব কিছুই মেনে নিয়েছে সাব্বির। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাবার সমান কাজ করছে সে।
শুধু সাব্বিরই নয়, এ উপকূলের মো. নুহু (১২), মো. রাসেল, মো. অন্তর, ১০ বছরের রিফাত, শাকিবসহ বলেশ্বর নদ ঘেঁষা অসংখ্য শিশু মাছ ধরা পেশায় নিয়োজিত।
এখানকার শিশু বড়দের সমানতালে নদীতে, সমুদ্রে জাল টেনে মাছ ধরে। সংসারে অভাব, পরিবারে বাবা-মা দ্বিতীয় বিয়ে অথবা মারা যাওয়ায় এসব কাজে বাধ্য হচ্ছে তারা। অনেক শিশু বিদ্যালয়ের গণ্ডিও পার হয়নি।
উপকূলীয় অঞ্চলের বিষখালী ও বলেশ্বর নদের পাড়ের জেলেপল্লীর অধিকাংশ শিশুর জীবনের গল্প এমন।
এ এলাকার ছেলেমেয়েদের খুব একটা পড়াশোনার সুযোগ হয় না। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়ি বাঁধের ঢালে ও বাঁধের ভেতরে-বাইরে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর শিশুরা এভাবেই বেড়ে উঠছে।
একাধিক শিশুর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইচ্ছা থাকলেও অভাবের কারণে পড়াশোনা করতে পারছে না। কেউ কেউ প্রথম কিংবা দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে।
রুহিতা গ্রামের সাব্বির বলে, সকাল হলেই বাবার সঙ্গে নৌকা নিয়ে বলেশ্বর নদীতে মাছ ধরতে যাই। অনেক সময় বন্যা, তুফানে আটকা পড়ি। এতে কোনো ভয় পাই না। বাবার সঙ্গে সমানভাবে জালও টানি, নৌকার ইঞ্জিন চালু করি, দিক নির্ণয় করি।
এ বয়সে এসব কাজ পারে কিনা এমন প্রশ্নে সাব্বির বলে, ‘কোনো উপায় নাই। বাবার সঙ্গে যেতে তো হবেই। নাইলে খামু কি?’
লেখাপড়া করতে মনে চায় কিনা এমন প্রশ্নে সাব্বির বলে, ‘না, লেখাপড়া করতে মনে চায় না। মাছ ধরি খাই, কোনো বাধা নাই। ’
কথা হয় একই গ্রামের ১২ বছরের মো. নুহুর সঙ্গে। নুহু বলে, দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। বাবা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ তাই চার বছর ধরে মাছ ধরছি। ২ বোনের ভবিষ্যতের কথা ভাবছি। লেখাপড়ার ইচ্ছে থাকলেও পারি না। ২ থেকে ৩ দিন কাজ করে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পাই। তা দিয়াই বাবার সংসারে সহযোগিতা করি।
সাব্বিরের বাবা আর্শ্বেদ আলী বলেন, ‘মোগো কষ্টের জীবন। মাছ না ধরে সংসার চালাতে কষ্ট হয়। নদীতে না গেলে তো জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। মাইয়া পোলা কেমনে স্কুলে পাঠামু, লেখাপড়া করামু, বই, খাতা কলম কেনারই টাহা নাই। পেটে ভাত দেওয়ার জন্য শিশুদের অল্প বয়সেই কাজে নামাতে হয়। ’
তিনি আরও বলেন, ‘সাব্বির শুধু নাম, ঠিকানা লিখতে পারে। একটি এনজিওর শিশু শিখন কেন্দ্রে কয়েকমাস পড়ছিল। এরপর আর পড়া লেখা হয় নাই। বাপ দাদার পেশায় ছেলেকেও নিয়েছি। ’
এদিকে শিশুদের অধিকার সুরক্ষায় আইন থাকলেও বিচ্ছিন্ন এসব জনপদে তাদের শিশুসহ অধিকার নিশ্চিতে তেমন কোনো সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। যাও দেখা যাচ্ছে তা একেবারেই অপ্রতুল। পরিবার বা শিশুদের আগ্রহ থাকলেও অভাবের কারণে শিশুরা শিক্ষা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। জড়িয়ে পড়ছে শিশুশ্রমে। বিশ্বজুড়ে শিশু অধিকার সুরক্ষায় ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে শিশু অধিকার সনদ (সিআরসি) গঠিত হয়।
সিআরসি গঠন করার পর শিশু অধিকার সুরক্ষায় বাংলাদেশ সরকার জাতীয় শিশু নীতিমালা ২০১১, শিশু আইন ২০১৩, জাতীয় শিক্ষা নীতিমালা ২০১০ এবং জাতীয় শিশুশ্রম-নিরোধ নীতিমালা ২০১০ প্রণয়নসহ বিভিন্ন প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিলেও পাথরঘাটার উপকূলীয় এলাকার চিত্র একবারেই ভিন্ন। দারিদ্র্যের কারণে এসব এলাকায় কোনও নীতিমালাই কার্যকর হচ্ছে না। পেটের তাগিদে উত্তাল সাগরেও মাছ শিকারে নামছে এখানকার শিশুরা।
এসব আইন ও নীতিমালায় শিশুদের সুরক্ষায় বিষয় নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে এ আইন ও নীতিমালা শুধু কাগজে কলমেই আটকে আছে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ছে অহরহ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অর্থ সঙ্কটে পড়ে এমন অনেক শিশুকেই শ্রমে নিয়োজিত করছেন গরীব অভিভাবকরা। অনেকে আবার অভিবাবকহীন হয়ে পেটের দায়ে আসে ঝুঁকিপূর্ণ এসব কাজে।
শিশুদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের প্রজেক্ট ম্যানেজার ইউকেএম ফারহানা সুলতানা বাংলানিউজকে বলেন, বেশি সংখ্যক শিশু উপকূলীয় অঞ্চলে। সে কারণে নানা দুর্যোগ সরাসরি মোকাবেলাসহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে শিশুদের সকল অধিকার নিশ্চিত করতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উপকূলের শিশুদের সুযোগ দেওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, উপকূলের শিশুদের শিশুর অধিকার নিশ্চিত না করা গেলে দিনদিন শিশু শ্রমের হার যেমন বাড়বে, তেমনি শিক্ষা বঞ্চিতদের সংখ্যাও বাড়বে। ফলে এ জন্য নতুন নতুন গবেষণারও দরকার রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০২১
এনএইচআর