সুন্দরবন (দুবলার চর) থেকে ফিরে: বাংলা সনের কার্তিক মাসে (নভেম্বর) সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় শুঁটকিপল্লী দুবলার চরে শুরু হয় জেলেদের কর্মযজ্ঞ। তখন হেমন্তের শুরু।
আপাত দৃষ্টিতে জেলেদের এই কর্মযজ্ঞ বাধাহীন মনে হলেও প্রকৃত অবস্থা তা নয়। সেখানে চলে ‘সাহেবদের’ শোষণ নিয়ন্ত্রণ। জেলেদের জলজীবনের আতঙ্ক এই সাহেবরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।
দীর্ঘ প্রচেষ্টায় দস্যুমুক্ত হওয়ায় সুন্দরবনে জেলেদের দস্যু আতঙ্ক কেটেছে অনেকটাই। কিন্তু ‘সাহেবদের’ শোষণে তাদের জীবন অতিষ্ট। দুবলায় আসা ৩০ হাজার জেলের সব কর্মযজ্ঞ ১৫ জন ‘সাহেব’ নিয়ন্ত্রণ করেন। আর সাহবদের ‘সাহেব’ দুবলার ফিসারম্যান গ্রুপের সভাপতি কামাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি একচ্ছত্রভাবে ক্ষমতার জোরে পুরো দুবলার চর নিয়ন্ত্রণ করেন। জেলেদের অনেকে তাকে ‘বড় সাহেব’ বা ‘কামাল মামা’ বলে ডাকেন।
সম্প্রতি সুন্দরবনের দুবলার চরে সরেজমিনে ঘুরে ও জেলে সম্প্রদায়সহ স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। জেলেরা তাদের জিম্মি দশার কথা বলেতেও ভয় পান।
জেলেরা জানান, দুবলার চরে সব চলে কামাল সাহেবের ইচ্ছায়। তিনি যা বলবেন, জেলেরা তাই করতে বাধ্য। নয়তো কারো রক্ষা নেই। ব্যবসা তো দূরে থাক চর ছেড়ে পালাতে হবে। মাছ ধরার মৌসুমে সমুদ্রের ইলিশসহ বিভিন্ন মাছ নদী-খালে আসে। সুন্দরবনের কুঙ্গা ও মরা পশুর নদসহ দুবলার চরের আশপাশে প্রচুর মাছ থাকে। কিন্তু চরের চারপাশের এলাকা কামাল উদ্দিনের দখলে। এই এলাকায় তার অগোচরেও কেউ জাল ফেরতে পারে না। আর যদি কেউ জাল ফেলেন তবে তার রক্ষা নেই। এই কারণে মাছ ধরতে জেলেরা সুন্দরবনের অভয়ারণ্যে ঢুকে পড়ে। এছাড়া বিশাল জলরাশির বিভিন্ন এলাকাও তার দখলে। কে কোথায় জাল ফেলবে সেটাও তিনি নির্ধারণ করে দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন জেলে বাংলানিউজকে জানান, সাহেব কামাল উদ্দিন খুব চতুর ও ভয়ঙ্কর লোক। তার সঙ্গে যারা ব্যবসা করতে গেছেন তারাই নিঃস্ব হয়েছেন। তার আক্রোশের কারণে অনেক জেলে সর্বশান্ত হয়েছেন, অনেক জেলেই দুবলার চরে ঢুকতে পারেন না।
কথোপকথনে জেলেরা একটি ঘটনার বিষয়ে জানান, নব্বইয়ের দশকে এক মৎস্যজীবী এই চরে মাছের ব্যবসা করতে এসেছিলেন। ভালই করছিলেন তিনি। তখন এই কামাল উদ্দিন তাকে টোপ দিয়ে নিজের সঙ্গে ব্যবসা করতে বলেন। তখন ৮-১০ বছর পর্যন্ত ব্যবসা করে ওই মৎস্যজীবীর তিনটি কার্গো বোট দখল করে নেন এই কামল উদ্দিন। এরপর তাকে নানা হুমকি দিয়ে চর থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। ওই মৎস্যজীবী এখন নিঃস্ব। কিন্তু কামালের ভয়ে তিনি এই দুবলার চরে আসতে পারেন না। এমন অনেক জেলে ও মৎস্যজীবী রয়েছেন কামালের সব নির্যাতন মুখ বুঝে সহ্য করে যাচ্ছেন।
জেলেদের অভিযোগ, মূলত জেলেরা বন বিভাগ থেকে মাছ ধার জন্য লাইসেন্স বা অনুমোতি পত্র পান না। এই লাইসেন্স নিয়ন্ত্রণ করেন এই কামাল উদ্দিনসহ সাহেবরা। কোন জেলে কোথায় মাছ ধরবেন, কার কাছে বিক্রি করবেন, সব কিছুই কামাল সাহেব নিয়ন্ত্রণ করেন। ঋণ-লগ্নি ও দাদনসহ, জেলেদের নিয়ন্ত্রণ, কাঁচা মাছ ও শুঁটকিপল্লী নিয়ন্ত্রণ করে এই কামাল উদ্দিন। দুবলার চরে চারটি সাইক্লোন শেল্টার রয়েছে। এর মধ্যে মেহেরআলী সাইক্লোন শেল্টার দখল করে গড়ে তুলেছেন নিজের প্রাসাদ। মৌসুমের ৫ মাস কামাল উদ্দিন রাজার হালে এখানেই থাকেন এবং চরের সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিজের আখের গোছান। দুবলার চরের আলোরকোলে গড়ে ওঠা নিউ মার্কেট পুরোটাই এককভাবে কামাল উদ্দিনের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ৯৬টি দোকানের কেউই ভয়ে কামালের বিরুদ্ধের কোনো কথা বলতে চান না।
জেলেরা আরও অভিযোগ করেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র থেকে মাছ ধরি কিন্তু সাহেবদের যন্ত্রণায় মাছের সঠিক মূল্য পাই না। কামাল উদ্দিন এই চরের মাছ ও শুঁটকির দর নিয়ন্ত্রণ করেন। এছাড়া চিংড়ি মাছের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তার হাতেই। অনেক সময় জেলেরা নদী বা সমুদ্র থেকে চাকা চিংড়ি ধরেন, কিন্তু সেগুলো কামালের লোকজন নিয়ে যায়। আবার জেলেরা কম মূল্যে কামালের কাছেই চিংড়ি বিক্রি করতে বাধ্য হন। বড় কোনো মাছ জেলেদের জালে ধরা পড়লে সেই মাছও দুবলায় আনা হয় না। জেলেদের নৌকা থেকে কামাল উদ্দিনের লোকজন সেগুলো নিয়ে যায়।
বন বিভাগের সূত্র ও মৎস্যজীবীরা জানান, মৌসুমে মাছ ধরার জন্য ১০ হাজার টাকা ফি দিয়ে বন বিভাগ থেকে লাইসেন্স সংগ্রহ করা হয়। ওই লাইসেন্স প্রতিবছর নবায়ন করতে খরচ হয় ৭০০ টাকা। এই মৌসুমে দুবলার চরের স্থানীয় ও আশপাশের লোকদের মধ্যে ১৫ জন মাছ ধরার অনুমতি পেয়েছেন। তাদের মধ্যে- কামাল উদ্দিন আহমেদ, আফিয়া বেগম, খান শফিউল্লাহ, শেখ মইনুদ্দিন আহমেদ, আরিফ হোসেন, রেজাউল শেখ, এবি এম মুস্তিাকিন, ইদ্রিস আলী, হাকিম বিশ্বাস, জালাল উদ্দিন আহমেদ, সুলতান মাহমুদ, বেলায়েত সরদার, কামরুন নাহার, শাহানুর রহমান এবং আসাদুর রহমান সরদার। কিন্তু দুবলার চরে যারা কামাল সাহেবের তালিকাভুক্ত জেলে তারাই এখানে আধিপত্য তৈরি করতে চায়।
সুন্দরবনের দুবলার চর বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রহ্লাদ চন্দ্র রায় বলেন, ঘর নির্মাণসহ মাছ প্রক্রিয়াজাতের জন্য ১৫ জনের নামে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। তাদের লোকজন নিয়ে তারাই সব নিয়ন্ত্রণ করে। তবে কোনো বিচ্যুতির বিষয়ে আমাদের কাছে এখনও কেউ কোনো অভিযোগ করেনি।
জানা গেছে, পিরোজপুরের প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) জিয়া উদ্দিন আহমেদ ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে তার ছোট ভাই কামাল উদ্দিন আহমেদ, ভাগ্নে শাহানুর রহমান শামীম ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে সুন্দরবনের দুবলার চরে আসেন। বনদস্যু বাহিনীগুলোর হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত সুন্দরবনের জেলেদের সংগঠিত করে শুঁটকি মাছের ব্যবসা শুরু করেন। ২০১৩ সালে পূর্ব সুন্দরবনের চরপুঁটিয়ায় বন্দুকযুদ্ধে জলদস্যু মোর্তজা বাহিনীর চার সদস্য নিহত ও মেজর জিয়া গুলিবিদ্ধ হন। ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই অসুস্থ হয়ে মারা যান জিয়া। এরপর কয়েকজন সাহেবকে নিয়ে ভিন্নভাবে দুবলার চরের নিয়ন্ত্রণ নেন কামাল উদ্দিন।
জেলেদের বিস্তর অভিযোগের বিষয় সস্পূর্ণ অস্বীকার করে কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি জেলে, বাওয়ালি, মৌয়ালী ও শুঁটকি ব্যবসায়ীদের সার্বিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আসছি। এখানে জেলেরা নিরাপদে এখন মাছ আহরণ করতে পারে। কোনো চাঁদা দিতে হয় না। আমার কারণে এসব সম্ভব হয়েছে।
আরও পড়ুন >>> দুবলার চরের জলজীবন- ১
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০২১
এসজেএ/কেএআর