সিলেট আদালতপাড়া থেকে: আলোচিত শিশু সামিউল আলম রাজন হত্যা মামলায় মূল অাসামি কামরুলসহ ৪ আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করেছেন আদালত। একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, তিনজনকে সাত বছরের কারাদণ্ড ও দুইজনকে এক বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।
রোববার (০৮ নভেম্বর) বেলা ১২টা ৪০ মিনিটে সিলেট মহানগর দায়রা জজ আকবর হোসেন মৃধা আলোচিত এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন।
রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, রাজন হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার শিশু নির্যাতন রোধের ক্ষেত্রে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আদালত ৭৬ পৃষ্ঠার রায়ে শিশু সুরক্ষা আইনের কথা উল্লেখ করেন এবং নির্মম এ হত্যাকাণ্ডকে এরশাদ শিকদারের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড ও বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনার সঙ্গে তুলনা করেন।
অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, রায়ের বিরুদ্ধে তারা উচ্চ আদালতে যাবেন। সেখান থেকে আসামিরা খালাস পাবেন বলে আশাবাদী তারা।
মামলার ১৩ আসামির মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামি হলেন, মহানগরীর জালালাবাদ থানার কুমারগাঁও এলাকার শেখপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল মালেকের ছেলে কামরুল ইসলাম (২৪), চৌকিদার ময়না মিয়া ওরফে বড় ময়না (৪৫), তাজ উদ্দিন বাদল (২৮) ও পলাতক জাকির হোসেন পাভেল।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ময়না চৌকিদারকে অপর দু’টি ধারায় পৃথক পৃথকভাবে সাত বছর ও এক বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করেন আদালত।
হত্যাকাণ্ডের ভিডিওচিত্র ধারণকারী নূর মিয়ার যাবজ্জীবন প্রদান করেন আদালত। সাতবছরের সাজা হয় কামরুলের দুই ভাই মুহিত আলম ও আলী হায়দার ওরফে আলী এবং পলাতক আসামি শামীম আহমদের। অপর দুই আসামি আয়াজ আলী ও দুলালকে এক বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত।
দণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেক আসামিকে দশ হাজার টাকা করে জরিমানা এবং অনাদায়ে ৩ মাস করে সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন আদালত।
অপরাধ সন্দেহজনকভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় বেকসুর খালাস পান ফিরোজ মিয়া, আজমত আলী ও রুহুল আমিন।
এরশাদ শিকদারের নির্যাতনের মতো বর্বরোচিত
রাজন হত্যাকাণ্ডকে নির্মম বলে উল্লেখ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সিলেট জেলা জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। তিনি বলেন, বিড়াল যেভাবে ইঁদুরকে ধরে প্রথমে এনজয় করে, খেলা করে একটি সময় হত্যা করে। ঠিক সেভাবেই নরপিশাচেরা শিশুটিকে নিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রহার করেছেন। যারা আঘাত করে হত্যা করেছেন তাদের চারজনকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে।
যারা মৃতদেহ গুমের চেষ্টা করেছেন তাদের সাত বছর করে কারাদণ্ড এবং যারা রশি দিয়ে সাহায্য করেছেন তাদের এক বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
এ মামলার নথিপত্র সাত কার্যদিবসের মধ্যে উচ্চ আদালতে পাঠানো হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আদালত রাজন হত্যার ঘটনাকে এরশাদ শিকদারের মতো বর্বরোচিত ও বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
শিশু নির্যাতন রোধে দৃষ্টান্ত
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মফুর আলী বলেন, আদালত এ হত্যা মামলার ন্যায়বিচার করেছেন। রাজন হত্যার ক্ষেত্রে আদালতে শিশু সুরক্ষা আইনের রেফারেন্সও টানা হয়েছে।
মামলাটি ঐতিহাসিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, আদালত ঠিক চার মাসের মাথায় বিচারিক কার্যক্রম শেষে রায় দিয়েছেন। তাছাড়া আসামি কামরুলকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকার তৎপর ছিলো।
এ মামলাটি শিশু নির্যাতন রোধের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলেও মন্তব্য করেন অ্যাডভোকেট মফুর।
উচ্চ আদালতে যাবেন আসামিপক্ষ
রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। তাদের মতে, এ রায়ে তাদের আসামিরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তারা রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি হাতে পাওয়ার পর উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। তাদের আশা, উচ্চ আদালতে আসামিরা খালাস পাবেন।
কামরুলের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আলী হায়দার সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।
হত্যাকাণ্ডের মাত্র চার মাসের মাথায় ও বিচার শুরুর পর মাত্র ১৬ কার্যদিবসে এ মামলার রায় ঘোষণা করা হলো।
গত ০৮ জুলাই সিলেটের কুমারগাঁওয়ে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয় সদর উপজেলার কান্দিরগাঁও ইউনিয়নের বাদেআলী গ্রামের আজিজুল ইসলাম আলমের ছেলে রাজনকে।
নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের পর মরদেহ গুম করতে গিয়ে জনতার হাতে আটক হন কামরুলের ভাই মুহিত আলম। হত্যাকারীরা নির্যাতনের ২৮ মিনিটের ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে দেশে-বিদেশে নিন্দার ঝড় ওঠে। খুনিদের ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে জনতা।
রাজন হত্যাকাণ্ডের পর মহানগরীর জালালাবাদ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) বাদী হয়ে মুহিত আলমসহ অজ্ঞাত ৪/৫ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে গিয়ে হত্যাকারীদের সঙ্গে আর্থিক সমঝোতার অভিযোগে বরখাস্ত হন জালালাবাদ থানার ওসি (তদন্ত) আলমগীর হোসেন, এসআই জাকির হোসেন ও আমিনুল ইসলাম।
গত ১৬ আগস্ট সৌদি আরবে আটক কামরুল ইসলামসহ ১৩ আসামিকে অভিযুক্ত করে আদালতে এ হত্যা মামলার চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর সুরঞ্জিত তালুকদার।
গত ০৭ সেপ্টেম্বর মামলাটি বিচারের জন্য মহানগর দায়রা জজ আদালতে স্থানান্তর করেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট প্রথম আদালতের বিচারক সাহেদুল করিম।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর এ আদালতে মামলার প্রথম শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। গত ২২ সেপ্টেম্বর আদালতের বিচারক চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলায় সৌদি আরবে আটক কামরুলসহ ১৩ আসামির বিরুদ্ধে ৩০২/২০১/৩৪ ধারায় অভিযোগ (চার্জ) গঠন করে বিচার কার্যক্রম শুরু করেন।
গত ০১ থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ১০ কার্যদিবসে মোট ৩৬ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। কামরুলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২১ অক্টোবর ১১ জন সাক্ষী ফের সাক্ষ্য দেন তার উপস্থিতিতে। ২৫ অক্টোবর এ মামলায় ৩৪২ ধারায় আসামিদের মতামত গ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শুরু হয়।
গত ২৭ অক্টোবর তিন কার্যদিবসে মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আসামিদের উপস্থিতিতে ০৮ নভেম্বর রায়ের দিন নির্ধারণ করেন আদালতের বিচারক।
এদিকে নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের পর মামলার প্রধান আসামি কামরুল ইসলাম সৌদি আরবে পালিয়ে গিয়েও রক্ষা পাননি। প্রবাসীরা তাকে ধরে বাংলাদেশ দূতাবাসে হন্তান্তর করেন। পুলিশ সৌদি আরবে গিয়ে ইন্টারপোলের মাধ্যমে গত ১৫ অক্টোবর তাকে দেশে নিয়ে আসে।
আসামিদের মধ্যে গ্রেফতারকৃত কামরুল, তাজ উদ্দিন বাদল ও রুহুল আমিন ছাড়া অন্য ৮ জন ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৮, ২০১৫
এনইউ/এএএন/এএসআর