চলতি বছরের জুন মাসে প্রথম ধাপে এক্সপ্রেসওয়েটি বিমানবন্দর থেকে শুরু হয়ে বনানী পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার অংশ খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু বাড়তি টোলের বোঝার কারণে চালু হচ্ছে না প্রথম অংশটি।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) আওতায় নির্মিত হচ্ছে। এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে কার-মাইক্রোবাসে সর্বনিম্ন ১০০, বড় বাসে ২০০ ও ট্রাকে ৩০০ টাকা টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে বিমানবন্দর থেকে শুরু হয়ে বনানী পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার অংশে এ টোল পরিশোধ করতে হবে। এ স্বল্প দূরত্বে এত বেশি টোল অনেকেই পরিশোধ করবে না বিধায় এ অংশটুকু চালু করার সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে। অন্যদিকে পুরো ২৬ কিলোমিটার রুটের জন্য মাইক্রোবাসে সর্বনিম্ন ১২৫, বড় বাসে ২৫০ ও বড় ট্রাকে ৫০০ টাকা টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। ২৬ কিলোমিটার রুটের জন্য টোল নির্ধারণ ঠিক আছে। তবে দৈর্ঘ্য ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার অংশের জন্য টোলের পরিমাণ বেশি হয়ে যায় বলেই প্রথম ধাপে চালু হচ্ছে না এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।
সেতু বিভাগ সূত্র আরও জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়েতে বড় ট্রাকে প্রতি কিলোমিটারে টোল ২১ টাকা, বড় বাসে ১৫ টাকা ও মাঝারি ট্রাকে ১৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে সামগ্রিকভাবে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। মোটরসাইকেল ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতে পারবে না। এমনকি ওভারলোডেড কোনো ট্রাকও উঠতে পারবে না এ উড়াল সড়কে। উড়ালসড়কে ওভারলোড নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র (পোর্টেবল ওয়ে ব্রিজ বা ওজন পরিমাপকযন্ত্র) স্থাপন করা হবে।
প্রকল্পের পরিচালক এ এইচ এমএস আকতার বাংলানিউজকে বলেন, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। আমরা আশা করছি ২০২২ সালের মার্চ মাসে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হয়ে যাবে। ইতোমধেই প্রকল্পের কাজ সার্বিকভাবে ৫০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে।
বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত খুলে দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার মনে হয় কেউ এই স্বল্প দূরুত্বপথে মাইক্রোবাসে ১০০ টাকা টোল দিতে চাইবে না। তাই মনে করি, একসঙ্গে উন্মুক্ত করাই ভালো। তারপরও পিপিপি অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে প্রকল্পটি। সুতরাং সংশ্লিষ্টরাই ভালো বুঝবেন।
দ্বিতীয় ধাপে বনানী থেকে মগবাজার পর্যন্ত ৫ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার ও শেষ ধাপে মগবাজার থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত ৬ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ঢাকার উত্তর-দক্ষিণে বিকল্প সড়ক সৃষ্টি হবে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি হেমায়েতপুর-কদমতলি-নিমতলী-সিরাজদিখান-মদনগঞ্জ-ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক-মদনপুরে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করবে।
চট্টগ্রাম, সিলেটসহ পূর্বাঞ্চল এবং পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যানবাহন ঢাকায় প্রবেশ না করে সরাসরি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রবেশ করবে। উত্তরাঞ্চল থেকে আসা যানবাহনগুলো ঢাকাকে বাইপাস করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সরাসরি যাতায়াত করতে পারবে। এর ফলে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী অংশে যানজট দূর হবে। প্রকল্পের রুটগুলো হচ্ছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর-কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেঁজগাও-মগবাজার-কমলাপুর-সায়দাবাদ-যাত্রাবাড়ী-ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক (কুতুবখালী)। বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী যেতে সর্বোচ্চ সময় লাগবে ২০ মিনিট।
এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে ২৫ বছর পর্যন্ত টোল আদায় করবে ইতাল-থাই। এরই মধ্যে এ প্রকল্পে ইতাল-থাইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চীনের সিনো হাইড্রো করপোরেশন। বাস্তবায়নের পর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৮০ হাজার যানবাহন চলাচল করতে পারবে। পুরো এক্সপ্রেসওয়েতে থাকবে ১১টি টোল প্লাজা, এর মধ্যে পাঁচটি হবে এক্সপ্রেসওয়ের ওপরে।
উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ শেষ করার কথা ২০১৯ সালের জুনে। আর এ অংশটুকু ঢাকাবাসীর জন্য খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন সে সিদ্ধান্ত থেকেও সরে এসেছে কর্তৃপক্ষ। এ ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার রুট চলতি বছরে খুলছে না।
রুটটি এখনই খুলে দিলে আগারগাঁও এলাকায় নতুন ভোগান্তির সৃষ্টি হবে। এ অংশের নির্মাণ কাজ ২০১৯ এর ডিসেম্বরে শেষ করা হবে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত সম্পূর্ণ নির্মাণ কাজ ২০২০ এর ডিসেম্বরে গিয়ে শেষ হবে। ২০২১ সালে মেট্রোরেল সম্পূর্ণভাবে খুলে দেওয়া হবে। মেট্রোরেলের মতো ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েও সম্পূর্ণভাবে খুলে দেয়ার পরিকল্পনা করছে সংশ্লিষ্টরা। সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বাংলানিউজকে বলেন, ঢাকার যানজট নিরসনে ঢাকা এলিভেটেডে এক্সপ্রেসওয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সড়কের বাইরে দিয়ে আলাদা একটা অ্যালাইনমেন্ট চলে গেছে। আমি মনে করি এটা সম্পূর্ণভাবে খুলে দেওয়া মঙ্গল হবে। কিন্তু স্বল্প পরিসরে খুলে দিলে জটিলতা দেখা দেবে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বনানী থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত পিলারের কাজ প্রায় শতাভাগ শেষ হয়েছে। এখন পাইল ক্যাপের ওপর দিয়ে বসানো হচ্ছে আই গার্ডার। এরপরেই আই গার্ডারের ওপরে বসবে স্ল্যাব। স্ল্যাবের ওপর দিয়ে দ্রুত গতিতে চলাচল করবে যানবাহন। ইতোমধ্যেই প্রকল্পের কাজ ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় মোট ১৩০ একর ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, পুনর্বাসন বাবদ ৯৯৫ কোটি টাকা এবং ইউটিলিটি রিলোকেশন বাবদ ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। বসত বাড়িসহ কিছু স্থাপনা রয়েছে। প্রকল্পের অন্যতম চ্যালেঞ্জিং কাজ জমি অধিগ্রহণ ও বসতবাড়ি সরানো।
২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে বাস্তবায়নের কথা ছিল এ প্রকল্পটি। পরে মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন খাতে তৃতীয়বারের মতো ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে।
সব খাত মিলিয়ে প্রাথমিকভাবে মূল প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৮ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। যার মধ্যে ৬ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং ২ হাজার ২৫৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ড (ভিজিএফ) হিসেবে বাংলাদেশ সরকার বহন করবে। তৃতীয় ধাপে মোট প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ৬৫৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণে সরকার ২ হাজার ৭৮০ কোটি ৬০ লাখ টাকা সংস্থান করতে পেরেছে। বাকি ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি ১০ লাখ টাকা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) খাতের।
বাংলাদেশ সময়: ০২৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ২২, ২০১৯
এমআইএস/এইচএডি