ঢাকা, মঙ্গলবার, ২ পৌষ ১৪৩১, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

এমপি সামাদের মৃত্যু: অসমাপ্ত উন্নয়নের আক্ষেপ এলাকাবাসীর

নাসির উদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০১ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০২১
এমপি সামাদের মৃত্যু: অসমাপ্ত উন্নয়নের আক্ষেপ এলাকাবাসীর

সিলেট: সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদরের নুরপুরের বাড়িতে শৈশব কেটেছিল সংসদ সদস্য (এমপি) মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর। আলিশান এ বাড়ির নির্মাণশৈলী নিজের মতোই করেছিলেন তিনি।

বাড়ির প্রবেশদ্বারে বাবা মরহুম দেলোয়ার হোসেন চৌধুরীর নামে করেছেন দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলীতে গম্বুজ খচিত মসজিদ। মাটির নিচেও মসজিদটি সুবিস্তৃত। এ মসজিদে নামাজ আদায় করেন পুরো এলাকার মানুষ। পাশেই নারী শিক্ষার বিস্তারে মাহমুদ উস সামাদ-ফারজানা চৌধুরী স্কুল অ্যান্ড কলেজ। রাস্তার আরেক পাশে মক্তব রয়েছে তার মায়ের নামে। সাত সকালে ওই মসজিদে আরবী শিক্ষা দেওয়া হয় শিশু-কিশোরদের।
 
পরপর তিনবার নির্বাচিত এ সংসদ সদস্য কাজের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। যে কারণে প্রতি বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার রাজধানী ঢাকা থেকে নিজ বাড়িতে গেলে দলীয় নেতাকর্মী থেকে সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকতো তার দুয়ার। জনতার বিচরণ ছিল অবাদে। নেতাকর্মী থেকে সাধারণ মানুষ বিভিন্ন আবদার নিয়ে যেতেন তার কাছে। যে কারণে জনতার কাছে জননন্দিত হয়ে ওঠেছিলেন এ সংসদ সদস্য।
 
করোনাকালে এমপি সামাদ ঘটা করে খাবার নিয়ে হাজির হতেন অনেকের বাড়িতে। উপজেলা মাঠে বিশাল আয়োজন করে সাধারণ মানুষের হাতে খাদ্যসামগ্রী তুলে দিতেও দেখা গেছে তাকে।

মৃত্যুর আগে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদরে কাইয়ার গুদাম বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ, উপজেলার ঘিলাছড়া জিরো পয়েন্টে স্মৃতিস্তম্ভ করে দিয়ে অনুপ্রাণিত করেন মুক্তিযোদ্ধাদের। শিশু-কিশোরদের বিনোদনের জন্য উপজেলা সদরে কুশিয়ারা নদীর তীরে করে গেছেন শেখ রাসেল শিশু পার্ক। বৃদ্ধদের জন্য প্রস্তাবিত শেখ রাসেল প্রবীণাঙ্গন করার উদ্যোগ নিলেও সম্পন্ন করে যেতে পারেননি তিনি।
 
ফেঞ্চুগঞ্জ কুশিয়ারা নদীর সেতু পার হয়ে নিজের নামে করা আল্লাহু চত্বর করে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেছিলেন ‘আমি মারা যাবার পর এখান দিয়ে যারাই যাবেন, এ নামটি উচ্চারণ করলে মৃত্যুর পর সওয়াব আমার কবরে যাবে। ’  তার মৃত্যুর পর সেসব কথা এখন এলাকার মানুষের মুখে মুখে।

এছাড়া এলাকায় রাস্তাঘাটের শতভাগ উন্নয়ন শেষ করে যেতে না পারার আক্ষেপ পেয়ে বসেছে নির্বাচনী এলাকার লোকজনকে। তিনি থাকলে হয়তো সেসব কাজ হতো! অভিভাবকহীন হওয়ায় এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন নির্বাচনী এলাকার লোকজন।
 
উপজেলার হাকালুকির তীরে জিরো পয়েন্ট পর্যটন কেন্দ্রে অত্যাধুনিক নির্মাণশৈলীতে রিসোর্টের কাজও অসমাপ্ত অবস্থায় রেখে গেছেন এমপি সামাদ। উপজেলার জেটিঘাট সড়কটির কাজ শুরু করেছিলেন মাত্র। তার আগেই করোনা আক্রান্ত হয়ে পরপারে পাড়ি জমান তিনি। এ অসমাপ্ত কাজ এখন হবে কিনা, এ নিয়ে দ্বিধায় উপজেলার পালবাড়ি এলাকার লোকজন।  

স্থানীয় বাসিন্দা নিজাম উদ্দিন বলেন, এমপি সামাদের স্থলাভিষিক্ত কে হবেন। তিনি এসব অসমাপ্ত কাজ করবেন কিনা, সেই সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

উপজেলা যুবলীগের সভাপতি শাহ মাশার আহমদ বলেন, আমরা অভিভাবক হারা হয়ে গেলাম। তার নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনকে গুছিয়ে দিয়ে পরপারে চলে গেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্তও এলাকার উন্নয়নে অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় দায়িত্ব পালন করে গেছেন। রাস্তাঘাটের উন্নয়ন ব্যতিরেকেও শাহজালাল (র.) সারখানা নির্মাণে তার অবদান অনস্বীকার্য। শতভাগ বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় নিজের অবদান রাখতে করে গেছেন কুশিয়ারা পাওয়ার প্ল্যান্ট।
 
ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মহিব উদ্দিন বাদল বাংলানিউজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও অত্যান্ত আস্থাভাজন ছিলেন মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী। যে কারণে শেখ রাসেল শিশু-কিশোর পরিষদের মহাসচিবের পদটি যেন তার জন্যই বরাদ্দ ছিল। মৃত্যুর আগেও শেখ রাসেলের নামে এলাকায় বেশ ক’টি ফুটবল টুর্নামেন্ট চালু করেন তিনি। তার অসুস্থতার খবরে সেসব টুর্নামেন্ট স্থগিত রাখা হয়।  
 
উপজেলার ঘিলাছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল লেইস চৌধুরী বলেন, আমরা একজন সজ্জন ব্যক্তিকে হারালাম। তিনি এলাকায় অনেক উন্নয়ন করে গেছেন। কিন্তু কিছু না বলেই অকালে চলে গেলেন।
 
আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন, এমপি সামাদ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার পর আমার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল। ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে তার সাহচর্য পেয়েছি। সংসার জীবন শুরুর সময় অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা থেকে যখন দেশে আসি। তখন তিনি আমাকে রিসিভ করে বাসায় আশ্রয় দিয়েছিলেন। তার বাসা থেকে গিয়েই দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করি। রাজনৈতিক সব কর্মকাণ্ডে এমপি সামাদের সফল অংশগ্রহণ ছিল। প্রতিটি সভায় তিনি বক্তব্য না রেখে বলতেন আমি মোনাজাত করবো। তিনি সাদা মনের মানুষ ছিলেন। তিনি নির্বাচনী এলাকায় যেসব উন্নয়ন করে গেছেন, তার সেই স্মৃতিগুলো আমরা ধরে রাখবো।  

স্থানীয়রা বলেন, এমপি সামাদের ইচ্ছা ছিল অবসর জীবন বাড়িতে কাটাবেন। বলেছিলেন-‘আমি যখন রিটায়ার্ড কররো, এ বাড়িতেই থাকবো। তখন সকালে উঠে জানালা খুলে যেন মসজিদ দেখতে পাই। পুকুর ঘাটে হাওয়াখানায় বসেও যেন মসজিদ দেখতে পাই।  

আলিশান সেই বাড়ি আছে। নান্দনিক শৈলীতে সাজানো ঘরগুলো এখন সুনসান। শান বাধানো পুকুর ঘাট ও হাওয়াখানায় বসবেন না তিনি। হাওয়াখানায় মার্বেল পাথরে লিখা-‘একদিন আমরা কেউ থাকবো না থেকে যাবে মোদের স্মৃতি’ পিতা-মাতা, সাত ভাই ও চার বোনের নাম লিখে যান সেই পাথরে। সত্যি, সবই পড়ে রইলো। নেই কেবল তিনি। সেই আক্ষেপ স্বজনদেরও।
 
শুক্রবার (১২ মার্চ) সন্ধ্যায় বাড়ির সামনে নিজের হাতে দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলীতে করা মসজিদের পাশেই নির্ধারণ করে যাওয়া কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হলো। এরআগে বিকেল সোয়া ৫টায় ফেঞ্চুগঞ্জের কাশিম আলী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মরহুমের জানাজা সম্পন্ন হয়। এতে লাখো মানুষ অংশ নেন। চোখের জলে প্রিয় ব্যক্তি এমপি সামাদকে শেষ বিদায় জানান নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ।   
 
গত ৮ মার্চ সকালে তার করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হলে বিকেলে রিপোর্ট পজিটিভ আসে। এদিন বিকেলেই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। করোনা আক্রান্ত হয়ে বৃহস্পতিবার (১১ মার্চ) দুপুর ২টার দিকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। শুক্রবার দুপুর ১২টায় বিমান বাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে তার মরদেহ ফেঞ্চুগঞ্জে আনা হয়। সেখান থেকে মরদেহ তার নুরপুর গ্রামের বড় বাড়িতে নেওয়া হয়। দিনভর সেখানে দলীয় নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ এমপি সামাদের মরদেহে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় স্বজন, নেতাকর্মীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
 
এমপি সামাদ ১৯৫৫ সালের ৩ জানুয়ারি ফেঞ্চুগঞ্জের নুরপুর সম্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মরহুম দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী এবং মা আছিয়া খানম চৌধুরী।
 
বাংলাদেশ সময়: ১১০১ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০২১
এনইউ/আরআইএস/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।