ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ ভাদ্র ১৪৩১, ২৭ আগস্ট ২০২৪, ২১ সফর ১৪৪৬

জাতীয়

আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের বিরামহীন কর্মযজ্ঞ

ফাহিম হোসেন, ঢাবি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০২৪
আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের বিরামহীন কর্মযজ্ঞ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: রাজধানী বাড্ডার সানভ্যালি আবাসন এলাকার মাদরাসাতুস সুন্নাহের মাঠ। একটু এগিয়ে গেলেই চোখে পড়ে সহস্রাধিক সেচ্ছাসেবক বিরামহীন কাজ করছেন।

প্রথমে একটি বস্তায় চাল, তারপর হাত বদল হয়ে মসুর ডাল, লবণসহ কয়েকটি ভারি খাদ্যদ্রব্য নিয়ে তৈরি করছেন প্যাকেট। এ প্যাকেটগুলো ট্রাকভর্তি হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যাদুর্গত এলাকায়।

সেবামূলক সংগঠন আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে এ মাদরাসার মাঠে এক মহা কর্মযজ্ঞ চলছে। বন্যাকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে এ ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে সামাজিক সংগঠনটি।  

রোববার (২৫ আগস্ট) দুপুরে মাদরাসাতুস সুন্নাহ'য় পৌঁছে দেখা যায়, ফাউন্ডেশনের ত্রাণ কার্যক্রম দুই অংশে পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে আস-সুন্নাহ মাদরাসার মাঠে ভারি খাবারের অংশের ও পাশেই ফাউন্ডেশনের ড্রাইভিং শেডে শুকনো খাবারের অংশের কাজ চলছে।  

আস-সুন্নাহ মাদরাসার মাঠে বড় করে প্যান্ডেল করা হয়েছে। মাঠের পাশে রাস্তায় ১৮ থেকে ২০ টন করে লোড করা চাল, ডাল এবং সয়াবিন তেলের কয়েকটি ট্রাক ও কার্গো দাঁড়িয়ে আছে। একে একে সেসব আনলোড করে মাঠে স্তূপ করা হচ্ছে।  

অন্যদিকে মাঠে সেচ্ছাসেবকরা এসব বস্তা থেকে চাল, ডাল, লবণ ও তেল নিয়ে একটি প্যাকেট তৈরি করছেন। একটি বস্তায় ১০ কেজি চাল, দুই কেজি ডাল, এক কেজি লবণ ও ২ লিটার তেল যুক্ত করে ১৫ কেজির একটি প্যাকেট তৈরি করা হয়। তৈরি হওয়া প্যাকেটগুলো মাঠের পশ্চিম পাশে বিশাল স্তূপ করে রাখা হচ্ছে।  

ভারি খাবারের এ মাঠ পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের অ্যাডমিন মাসুম বিল্লাহ।  

তিনি বাংলানিউজকে জানান, আস-সুন্নাহর পাওয়া তহবিল থেকে বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী কিনে আনা হয়। রাতে এসব ট্রাক আসতে শুরু করে। এছাড়া দাতাদের থেকে ছোট-বড় উপহার পাওয়া যায়।  

সকাল ৭টায় কোরান তেলাওয়াতের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু হয়। এভাবে দুপুর পর্যন্ত একদিকে আনলোড করা ও অন্যদিকে প্যাকেটিংয়ের কাজ চলে। দুপুরে নামাজের পর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। আসরের পর থেকে ট্রাকে তৈরিকৃত প্যাকেট লোড করা শুরু হয়। স্বেচ্ছাসেবকের ওপর ভিত্তি করে রাত ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত এসব কাজ চলে। রাত ১০টার পর এসব ট্রাক বন্যাকবলিত এলাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এরপর সেচ্ছাসেবকদের রাতের খাবার দেওয়া হয়। তাদের জন্য রাতে থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে।  

মাসুম বিল্লাহ জানিয়েছেন, বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত ১৫০০ সেচ্ছাসেবক আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। তার মধ্যে কওমি মাদরাসা, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীসহ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও কার্যক্রমে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছেন। তবে এ কাজের সঙ্গে কোনো নারীর অংশগ্রহণ নেই।

তার দেওয়া তথ্যানুযায়ী, প্রতিদিন ৯টি ট্রাক ত্রাণ নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় যায়। প্রত্যেকটি ট্রাকে এক হাজার প্যাকেটে ১৫ টন খাবার লোড করা হয়। শুক্রবার ও শনিবার দুদিনে এ রকম ১৮টি ট্রাক বন্যাকবলিত এলাকায় পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে দুর্গম অঞ্চলে ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য ৬টি ট্রাক সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

‘ট্রাক লাগবে?’ ও ‘স্ট্রিটফাস্ট’ নামে দুই প্রতিষ্ঠান থেকে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনকে বিনা খরচে এসব ট্রাক সেবা দেওয়া হচ্ছে।  

দুপুরের পর ড্রাইভিং শেড ঘুরে দেখা যায়, প্রায় ১৫০ জন সেচ্ছাসেবক সেখানে শুকনো খাবার প্যাকেজিংয়ে কাজ করছেন।  

ড্রাইভিং শেডে পরিচালনায় রয়েছেন আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের মেন্টেইন ম্যানেজার মো. রবিউল ইসলাম।  

তিনি জানান, প্রত্যেক গাড়িতে ১৮০০ প্যাকেট শুকনো খাবার লোড করা হচ্ছে। প্যাকেটগুলোর মধ্যে রয়েছে চিড়া ২ কেজি, মুড়ি ২ কেজি, খেজুর ২ কেজি, লবণ ১ কেজি, চিনি ১ কেজি, বিস্কুট ২ প্যাকেট, স্যালাইন ২ প্যাকেট, গুড়া দুধ ১ প্যাকেট, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ১ পাতা, দেশলাই ১টি, মোমবাতি ১ ডজন ও ১ বোতল পানি।  

রবিউল বাংলানিউজকে বলেন, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের তহবিল থেকে আমরা এ পণ্যগুলো অর্ডার দিয়ে ক্রয় করি। এছাড়া অনেক দাতা এখানে প্রদান করেন। সেগুলোকেও আমরা পরিমাণ মাফিক প্যাকেট করি।  

সেচ্ছায় শ্রম দিতে মানুষের ভিড় 
রোববার মাঠ ও ড্রাইভিং শেড ঘুরে ব্যাপক স্বেচ্ছাসেবকের উপস্থিতি দেখা গেছে। তারা বলছেন, দেশের ক্রান্তিলগ্নে মানুষের পাশে দাঁড়াতেই তারা ছুটে এসেছেন।  
এ সময় জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া মাদরাসার দাওরায়ে হাদিস শ্রেণির শিক্ষার্থী কামরুল হাসান মাহফুজের সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের। গত তিনদিন ধরে তিনি যাত্রাবাড়ী থেকে বাড্ডার সাতারকুলে সেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে আসেন।  

তিনি বলেন, মানুষের জন্য কিছু করতে পারার ইচ্ছা থেকেই এখানে এসেছি। তাছাড়া এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলেম-ওলামারা রয়েছেন।  

বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিবিএ চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আসিফ রহমান এসেছেন তার বন্ধু জাহিদ হাসানের সঙ্গে।  

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, মানুষ বন্যাক্রান্ত। অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমরা তাদের সহায়তা করতে হয়তো অতদূর যেতে পারব না, তাই এখানে এসেছি।  

ত্রাণ কার্যক্রম পরপরই পুনর্বাসন প্রোগ্রাম শুরু
ত্রাণ কার্যক্রম শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের। প্রতিষ্ঠানটির ডেভেলপমেন্ট স্কিল ইনস্টিটিউটের অ্যাডমিন মাসুম বিল্লাহ বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, ত্রাণ প্রক্রিয়া শেষ করার পরই আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন বন্যার্তদের জন্য আবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার পরিকল্পনা করছে। এর আওতায় গৃহনির্মাণসহ অন্যান্য কাজ করা হবে। ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।  

দুর্গম এলাকায় পৌঁছানোর সাধ্য নেই
রোববার দুপুরে মাদরাসার মাঠে ত্রাণ কার্যক্রম দেখতে আসেন আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শায়খ আহমদুল্লাহ। যোহরের নামাজের পর তিনি সেচ্ছাসেবকদের কথা শোনেন এবং প্রশ্নের উত্তর দেন। এ সময় অনলাইনভিত্তিক বই বিক্রির প্ল্যাটফর্ম রকমারির সহ-প্রতিষ্ঠাতা মাহমুদুল হাসান সোহাগ উপস্থিত ছিলেন।  

শায়খ আহমদুল্লাহ বলেন, ঢাকা থেকে ত্রাণ গেলে সাধারণত মূল সড়কের পাশেই দিয়ে চলে আসা হয়। ফলে সড়কের পাশের একেকজন কয়েকবার ত্রাণ পান। কিন্তু আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দেয়।  

তবে দুর্গম এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, দুর্গম এলাকায় যাওয়ার সাধ্য আমাদের নেই। প্রশিক্ষিত বাহিনী যেমন সেনা-নৌ বাহিনী ছাড়া ত্রাণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বাহিনীগুলো চেষ্টা চালাচ্ছে। দুর্গম এলাকাগুলোতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা ত্রাণ পৌঁছে দেব। ইতোমধ্যে গবাদিপশুর জন্য ৬৭ টনের বেশি ভুসি সরবরাহ করা হয়েছে।

শায়েখ আহমদুল্লাহ বলেন, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন সব ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করে থাকে। আমাদের এখানে যারা স্বেচ্ছাসেবা দিচ্ছেন তাদের মধ্যে অনেক হিন্দু ভাইয়েরা আছেন। ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রেও আমরা খুঁজে খুঁজে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের আলাদাভাবে প্রায়োরিটি দিয়ে কাজ করি।

তিনি আরও বলেন, অনেক বন্যা হোক, আমরা অনেক ত্রাণের কাজ করবো- এটা আমাদের আকাঙ্ক্ষা নয়। আমরা চাই বন্যা আর না হোক। বন্যা হতে থাকবে আর আমরা মোকাবিলা করতে থাকবো এটা নয়। বন্যা যেন না হয় তার জন্য আমাদের নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের পানি নিষ্কাশন পদ্ধতির উন্নয়ন, নদীতে ড্রেজিং ও বন্যার কারণ চিহ্নিত করে সমাধান করতে হবে।

শায়েখ আহমদুল্লাহ বলেন, আমাদের স্বপ্ন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ; যুবকরা বেকার না হয়ে উদ্যোক্তা হোক। সেজন্য আমরা নানা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা যুবকদের দক্ষতা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট কোর্স, বিজনেস ম্যানেজমেন্টের কোর্স প্রশিক্ষণ দিয়ে চাকরি দিচ্ছি।

প্রসঙ্গত, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন একটি অরাজনৈতিক সামাজিক সেবামূলক সংগঠন হিসেবে ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিষ্ঠানটি ‘শিক্ষা, ‘সেবা’ ও ‘দাওয়া’ এ তিনটি খাত নিয়ে কাজ করে। প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে কোরবানি করে দুস্থদের মধ্যে গোস্ত বিতরণ, করোনাকালীন উবার ও সিএনজি চালকদের সহায়তা দেওয়া, বন্যায় ত্রাণ বিতরণ, শীতবস্ত্র বিতরণ, খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, নলকূপ স্থাপন, বৃক্ষরোপণসহ একাধিক সামাজিক কাজ করেছে।  

বর্তমানে বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হতাহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন, সারা দেশে ৩ লাখ বৃক্ষরোপণ, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট কোর্স, নারীদের জন্য ফ্যাশন টেলিং কোর্স, ঢাকায় ১০ হাজার নিম গাছ রোপণসহ একাধিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫১ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০২৪
আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।